আম, কাঁঠাল ও লিচুর ভালো ফলন পেতে যা করবেন
আম, কাঁঠাল ও লিচু সাধারণত উষ্ণ ও অব-উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলের জন্মে। ধারণা করা হয় বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে আম, কাঁঠাল ও লিচু সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল, কারণ এ ফলগুলো পুষ্টিমান ও স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়।
বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে আম, কাঁঠাল ও লিচু জন্মে কিন্তু দেশের উরাঞ্চলে এগুলোর বাণিজ্যিক আবাদ হয়ে থাকে। চাষিরা প্রতি বছর অনেক ক্ষতির শিকার হয়ে থাকেন সাধারণত দুই প্রকারের সমস্যার কারণে যথা-
- ১. প্রাকৃতিক কারণ (যেমন- ঝড়, শিলাবৃষ্টি, খরা প্রভৃতি) এবং
- ২. রোগ ও পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয়ে।
সঠিক পরিচর্যা, রোগ ও পোকামাকড় দমন করে প্রথম ক্ষতি আংশিক এবং দ্বিতীয় ক্ষতি প্রায় সম্পূর্ণ রূপে সমাধান করা সম্ভব। আম, কাঁঠাল ও লিচুর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ-পোকামাকড় দমনে করণীয় বিষয়ে আলোচনা করা যাক……
আমের গুটি ঝরা:
বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে আম ঝওে পড়া প্রকৃতির নিয়মেরই অংশ বিশেষ। মুকুলে প্রধানত: উভয়লিঙ্গ ফুলের অনুপাত বেশি হওয়া দরকার, কারণ এগুলিই পরাগায়িত হয়ে ফল ধারণ করতে সক্ষম। প্রাথমিক পর্যায়ে ফল ঝরার কারণসমূহ হচ্ছে পরাগায়ন না হওয়া, অপুষ্ট গর্ভমুন্ড, ত্রম্নটিযুক্ত ফুল, কোন কোন জাতে স্ব-অসঙ্গতিতা এবং বাড়ন্ত ফলের পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা।
অধিকন্তু আমের শুকনা ক্ষত বা অ্যানথ্র্র্রাকনোজ ও পাউডারি মিলডিউ রোগের আক্রমণ, হপার বা ফুতকি পোকা ও মিলিবাগ বা দধে পোকার আক্রমণ, দীর্র্ঘ সময় অনাবৃষ্টি, হরমোনের অসামঞ্জস্যতা, জাতগত বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি কারণে আম ঝরে যায়।
প্রতিকার :
ফল বৃদ্ধির সময়ে নিয়মিত সেচ দেয়া। প্রতি মুকুলে আমের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ফুল ফোটার ১০ ও ২০ দিন পর দুবার ১০ লিটার পানিতে ৬ গ্রাম হারে বোরিক এসিড স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। সমস্ত ফুল ফোটা অবস্থায় জিবরেলিক এসিড প্রতি লিটার পানিতে ৫০ মিলিগ্রাম হারে স্প্রে করলে আমের গুটি ঝরা কমানো যায়।
আমের রোগ ও পোকার আক্রমণ থেকে আমের গুটি রক্ষা করতে গুটির আকার মটর দানার মতো হলে একটি কীটনাশক (রিপকর্ড/সিমবুস/ক্যারেটে এক লিটার পানিতে ১ মিলি. হারে) ও একটি ছত্রাকনাশক (ডায়থেন এম ৪৫/ইনডোফিল এম ৪৫ এক লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে) একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এ ছাড়াও আমের গুটি মটরদানার আকার হলে প্রতি লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ইউরিয়া সার মিশিয়ে স্প্রে করলে গুটি ঝরা কমানো যায়।
আমের হপার বা ফুতকি :
পূর্ণ বয়স্ক ও নিম্ফ (বাচ্চা) উভয়েই আমের মুকুল ও কচি অংশ থেকে রস চুষে খায়। পোকার আক্রমণে মুকুলের ফুল শুকিয়ে যায়। মুকুলের রস চোষার সময় পোকা প্রচুর পরিমাণে মধুরস ছেড়ে দেয়। এর ফলে পাতায় সুটি মোল্ড ছত্রাক আক্রমণ করে পাতা কালো বর্ণ করে ফেলে। এতে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যহৃত হয়।
দমন ব্যবস্থাপনা :
আম বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। মরা ডাল-পালা কেটে দিতে হবে। মুকুল আসার আগে এবং গুটি বাঁধার পর সেভিন প্রতি লিটারে ১ গ্রাম স্প্রে করা। মুকুল ২-৪ ইঞ্চি হলে ফুল ফোটার আগে রিপকর্ড/সিমবুস/কা্যরেটে এক লিটার পানিতে ১ মিলি. হারে স্প্রে করা।
আমের শুকনা ক্ষত বা অ্যানথ্র্র্র্রাকনোজ রোগ :
আমের সর্বাধিক ক্ষতিকারক রোগ। পৃথিবীর সর্বত্রই আমের ক্ষতি করে। এক প্রকার ছত্রাকের কারণে এ রোগ হয়। প্রায় সব জাতে এ রোগ দেখা যায়। মাঠে এবং সংগ্রহের পর উভয় পর্যায়ে ক্ষতি করে। মুকুল, কচিপাতা, কুঁড়ি, কচি আম, বাড়ন্ত আম বা পাকা আমে এ রোগের লক্ষণ দেখা যায়।
মুকুল কালো রঙ ধারণ করে শুকিয়ে যায়। কচিপাতা ছোট বাদামি দাগ পড়ে। দাগ বাড়তে থাকে ও কোষ শুকিয়ে মারা যায়। কচি আমের গায়ে কালো দাগ পড়ে ও আম ঝরে যায়। বাড়ন্ত আমের গায়ে কালো দাগ পড়ে। আম পচে ঝরে পড়তে পারে। পাকা আমের গায়ে অসম আকৃতির বাদামি/কালো দাগ পড়ে এবং অনুকূল আবহাওয়ায় আম পচতে শুরু করে।
প্রতিকার :
আম বাগান পরিষ্কার রাখা। রোগাক্রান্ত ডাল ও পাতা কেটে পুড়িয়ে ফেলা। মুকুল ৪-৬ ইঞ্চি হলে, কচিপাতায়, আম মটর দানা অবস্থায় ও বাড়ন্ত আমে ১-২ বার মেনকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক (ডায়থেন এম ৪৫/ইন্ডোফিল এম ৪৫/পেনকোজেব) এক লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করা।
রোগ দেখা দিলে টিল্ট ২৫০ ইসি এক লিটার পানিতে ১ মিলি. হারে স্প্রে করা। পাকা আম গরম পানিতে ৫৫ সে. তাপমাত্রায় (যে তাপমাত্রায় হাত ডুবালে সহ্য করা যায়) ৫-৭ মিনিট ডুবিয়ে পরিশোধন করতে হবে।
আম ফেটে যাওয়া :
বিভিন্ন কারণে আম ফেটে যেতে পারে। কারণসমূহ হচ্ছে জাতগত বৈশিষ্ট্য (যেমন-আশ্বিনা), বোরণ সারের অভার, মাটিতে রসের হঠাৎ হ্রাস-বৃদ্ধি।
প্রতিকার :
মাটিতে জৈব সার (গোবর/সরিষার খৈল) প্রয়োগ করতে হবে। ফেটে যাওয়া প্রতিরোধী জাতের চাষাবাদ করা। গুটির আকার মটরদানার মতো হলে ১০ লিটার পানিতে ৬ গ্রাম হারে বোরিক এসিড স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
কাঁঠালের মুচি পচা রোগ :
এক ধরনের ছত্রাকের কারণে এ রোগের সৃষ্টি হয়। জীবাণু পুরুষ ফুল ও ছোট ফলে আক্রমণ করে। ফলের ওপর কাল দাগের সৃষ্টি হয়। আক্রান্ত ফল বা মুচি পচে ঝরে যায়।
প্রতিকার :
আক্রান্ত মুচি বা ফল সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হবে। বোর্দো মিক্সচার (১% অর্থাৎ এক লিটার পানিতে ১০ গ্রাম তুঁতে ও ১০ গ্রাম চুন)) বা ডায়থেন এম ৪৫ এক লিটার পানিতে ৩ গ্রাম হারে ১২ দিন পর পর ২/৩ বার স্প্রে করতে হবে।
কাঁঠালের ফল পচন রোগ :
এক ধরনের ছত্রাকের কারণে এ রোগের সৃষ্টি হয়। আক্রান্ত ফলের গায়ে কালো দাগের সৃষ্টি হয় দাগ ক্রমান্বয়ে বড় হতে থাকে। আক্রান্ত স্থানের কোষ পচে যায়।
প্রতিকার :
বোর্দো মিক্সচার (২%) বা মেনকোজেব এক লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
কাঁঠাল ফেটে যাওয়া :
দীর্ঘ খরার পর হঠাৎ বৃষ্টি, শুষ্ক ও গরম হাওয়া এবং রোগ-পোকার আক্রমণে ফল ফেটে যেতে পারে। এ ছাড়া মাটিতে বোরন বা ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দিলেও ফল ফেটে যেতে পারে।
প্রতিকার :
মাটিতে জৈব সার ও নিয়মিত সেচ প্রদান করতে হবে। গাছের গোড়ায় পানি না জমে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। গাছের গোড়ায় ক্যালসিয়াম সার (ডলোচুন -২০০ গ্রাম) দিতে হবে। বোরাক্স এক লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। রোগ-পোকার আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে।
লিচু ঝরে পড়া :
ফল ঝরা লিচুর সাধারণ সমস্যা। আবহাওয়া শুষ্ক হলে বা গাছে হরমোনের অভাব থাকলে ফল ঝরে পড়তে পারে।
প্রতিকার :
ফল মটরদানা এবং মার্বেল আকার অবস্থায় লেবেলে নির্দেশিত মাত্রা অনুযায়ী পস্নানোফিক্স/মিরাকুলান স্প্রে করতে হবে। গুটি বাঁধার পর জিংক সালফেট এক লিটার পানিতে ১০ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। রোগ-পোকার আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে।
লিচু ফেটে যাওয়া :
দীর্ঘ খরার পর হঠাৎ বৃষ্টি, শুষ্ক ও গরম হাওয়া, রোগ ও পোকার আক্রমণে ফল ফেটে যেতে পারে। এ ছাড়া মাটিতে বোরন বা ক্যালসিয়ামের অভাব থাকলে এবং আগাম জাতে এ সমস্যা বেশি দেখা যেতে পারে।
প্রতিকার :
মাটিতে জৈব সার ও নিয়মিত সেচ প্রদান করতে হবে। গাছের গোড়ায় ক্যালসিয়াম সার (ডলোচুন-১০০ গ্রাম) দিতে হবে। বোরিক এসিড এক লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। রোগ-পোকার আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে।
লিচু ফল পচা অ্যানথ্রাকনোজ রোগ :
সংগ্রহোত্তর লিচুর একটি প্রধান সমস্যা। এক ধরনের ছত্রাকের কারণে এ রোগের সৃষ্টি হয়। এ রোগের আক্রমণে ফলের ওপর বাদামি দাগের সৃষ্টি হয় যাতে ফলের বাজার দর কমে যায়। বেশি আক্রান্ত ফল নষ্ট হয়ে খাওয়ার অনুপযুক্ত হয়ে যায়।
প্রতিকার : ফল গাছে থাকা অবস্থায় নিয়মিত মেনকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক এক লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করলে সংগ্রহের পর এ রোগের আক্রমণ হয় না।
লেখক : কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম
পিএইচডি গবেষক (এনএটিপি), হাবিপ্রবি, দিনাজপুর ও অতিরিক্ত উপপরিচালক (এলআর), ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা।
কৃষি টিপস / আধুনিক কৃষি খামার